শাহিনুর রহমান শাহিন ফুলবাড়ী(কুড়িগ্রাম)ঃ বছরের পর বছর কেটে গেলো দীর্ঘ ১০টি বছর। পায়নি আলোচিত ফেলানী হত্যাকান্ডের ন্যায্য বিচার। বিএসএফের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্টে বিচার এবং পূণর্বিচারের রায়ে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ভারতের সুপ্রীম কোর্টে রিট করা হলেও তারিখের পর তারিখ বদলেছে। শুনানী হয়নি। করোনা পরিস্থিতির কারণে এই শুনানী এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তারপরও ন্যায় বিচার পাওয়ার প্রত্যাশায় এক দশক ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন ফেলানীর পিতা-মাতাসহ স্বজনরা।
ভারতের বিএসএফের গুলিতে ফেলানী নিহত হওয়ার দশম বার্ষিকী আজ (৭ জানুয়ারি)। বিগত ২০১১ সালের এই দিন ভোরে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে ভারত থেকে দেশে ফেরার সময় ১৪ বছর বয়সী কিশোরী ফেলানীকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছিল বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ। তার লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে ছিল ৫ ঘন্টা। এরপর বিভিনপ প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুর ৩০ ঘন্টা পর ফেলানীর মরদেহ দাফন করা হয়েছিল নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের পৈত্রিক ভিটায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুচবিহারে অবস্থানরত তৎকালীণ ১৮১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের অধিনস্ত চৌধুরীহাট বিওপি’র কোম্পানী কমান্ডারের এফআইআর-এর ভিত্তিতে দিনহাটা থানায় একটি জিডিই দায়ের করা হয় (জিডিই নম্বর-৩৪৯)। পরে এরই ভিত্তিতে ওই দিন একটি ইউডি মামলা রেকর্ড করা হয় (মামলা নম্বর- ৫/১১)।
এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের কুচবিহারের সোনারী এলাকায় অবস্থিত ১৮১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নে স্থাপিত বিএসএফের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্টে ২০১৩ সালের ১৩ আগষ্ট তারিখ থেকে ফেলানী হত্যার বিচার শুরু হয়েছিল। এই কোর্ট ওই সালের ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেয়।
ফেলানীর পিতা-মাতা এই রায় প্রত্যাখান করলে রায় ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর মামলাটি পুণর্বিচারের সিদ্ধান্ত নেয় বিএসএফ কর্তৃপক্ষ। এরই প্রেক্ষিতে একই বিচারক নিয়ে গঠিত বিএসএফের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্টে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুণর্বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। কয়েক দফা তারিখ পেছানোর পর ২০১৫ সালের ২ জুলাই আবার বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ বলে রায় দেয় এই কোর্ট। বিএসএফের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্টের বিচার এবং পূণর্বিচারে সাক্ষ্য দিতে কুচিবহার গিয়েছিলেন ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম। তাকে সহযোগিতা করতে নিযুক্ত হয়ে সাথে গিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর এসএম আব্রাহাম লিংকন এবং কুড়িগ্রামস্থ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের তৎকালীণ অধিনায়কগণ।
এদিকে বিএসএফের জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্স কোর্টের রায় প্রত্যাখান করে পুনরায় তদন্ত এবং বিচার চেয়ে ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম এবং ভারতের কোলকাতাস্থ মানবাধিকার সংগঠন ‘বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)’ -এর সাধারণ সম্পাদক কিরিটি রায় যৌথভাবে বাদি হয়ে ২০১৫ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের সুপ্রীম কোর্টে একটি রিট আবেদন দাখিল করেন (রিট আবেদন নম্বর-১৪১/ ২০১৫)। বাংলাদেশ আইন ও শালিস কেন্দ্র এই রিট আবেদন দাখিলে সহায়তা করেন। এছাড়া রিটের হলফনামায় ফেলানীর পিতা নুর ইসলামের কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর এসএম আব্রাহাম লিংকন স্বাক্ষর করেছিলেন।
রিট আবেদনে ফেলানী হত্যা মামলাটি পশ্চিমবঙ্গের বাইরের সিবিআই অথবা এসটিআই কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত, অন্য বিচারক দিয়ে বিচার এবং ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। রিট আবেদনে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্য সচিব, বিএসএফের মহাপরিচালক এবং সিবিআই-এর পরিচালক এই ৪ জনকে বিবাদী করা হয়।
এরপর ২০১৫ সালের ১৪ আগষ্ট ভারতের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত ফুল বেঞ্চে শুনানী শেষে রিট আবেদনটি গ্রহণ করে বিবাদীগণকে জবাব প্রদানের জন্য নোটিশ জারীর আদেশ দেওয়া হয়।
এছাড়া এর আগে ২০১৩ সালের ২৭ আগষ্ট ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাদি হয়ে ভারতের সুপ্রীম কোর্টে একটি রিট আবেদন দাখিল করেছিলেন।
এজন্য এই দু’টি রিটের পরবর্তী শুনানী একই সঙ্গে করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় বিবাদীপক্ষগণ নোটিশের জবাব সুপ্রীম কোর্টে দাখিল করলেও পরবর্তী শুনানী এখন পর্যন্ত হয়নি।
কন্যার হত্যার বিচার পাবার প্রত্যাশায় অপেক্ষায় থাকা ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেন, আমার নিরীহ-নিরাপরাধ নাবালিকা কন্যা ফেলানীকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্য নিষ্ঠুর অমিয় ঘোষ। এই স্মৃতি আমি ভুলতে পারিনা। আমি চাই সীমান্তে গুলিতে আর কোন মায়ের কোল খালি না হয়। তাই ফেলানী হত্যার ন্যায্য বিচার চাই।
ফেলানীর পিতা নুর ইসলাম বলেন, দুইবার কুচিবহারে গিয়ে বিএসএফের কোর্টে সাক্ষ্য দিয়েছি। কোন ন্যায্য বিচার পাইনি। ভারতের সুপ্রীম কোর্টে রিট করেছি। শুনানীও হচ্ছে না। তারিখের পর তারিখ পড়ছে। তারপরও আশা ছাড়িনি। অপেক্ষায় আছি। আর যতদিন পর্যন্ত ন্যায্য বিচার না পাই-ততদিন পর্যন্ত বিচার চাইতে থাকবো।
এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর এসএম আব্রাহাম লিংকন বলেন, রিট শুনানীর জন্য সুপ্রীম কোর্টের কার্যতালিকার ৩ আইটেমে ছিল। পরবর্তীতে কার্যতালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এ অবস্থায় করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন ফিজিক্যাল কোর্ট হচ্ছে না। আর করোনা যাওয়ার পরে কার্যতালিকায় কবে আসবে তার উপর নির্ভর করছে শুনানী। তারপরও প্রত্যাশা করছি সুপ্রীম কোর্ট রিটটি নিস্পত্তি করবে। এতে যেমন ন্যায্য বিচার পাওয়া যাবে-সেই সাথে যে দিক নির্দেশনা দেওয়া হবে তা দুই দেশের সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করি।