ফয়সাল আমানঃ বরিশালে শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে নির্যাতনের পর মৃত্যুর ঘটনায় আলোচনায় আসা এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমে আছে। বিভিন্ন সময়ে মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়াটার্সে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন অনেকেই। তারা এখন নতুন করে কথা বলছেন গণমাধ্যমের সাথে। ওদিকে ব্যক্তির দায়ভার কখনোই পুরো ডিপার্টমেন্ট নিবে না বলে জানানো হয়েছে বিএমপি হেডকোয়াটার্স থেকে। ইতিমধ্যে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করে দিয়েছে।
গতকাল দুপুরে সাগরদী হামিদ খান সড়ক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে শুধু সমবেদনা জানাতে নয়, বিগত দিনে এসআই মহিউদ্দিনের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার অনেকেই আসছেন। নিজেদের ভয়ানক সেইসব অভিজ্ঞতার কথাও বলছেন অকপটে। তেমনি একজন শের-ই-বাংলা সড়কের বাসিন্দা মোঃ কামাল। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর আমি বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় একটি অভিযোগের স্বাক্ষি দিতে গিয়েছিলাম।
অভিযোগটি ছিল, কোতয়ালী থানার তৎকালীন এসআই শামীমের ঘুষ দাবীর বিষয়ে। আমাকে থানায় অভিযোগের বিষয়ে তদন্তে ডেকে নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে সহকারী কমিশনার (এসি) রাসেল। মামলার তদন্তভার দেন এসআই মহিউদ্দিনের কাছে। তিনি কোন কিছু তদন্ত না করেই আমাকে নিয়মিত হয়রানি করে চলছেন। কিছুদিন আগেও আমাকে এসে হুমকি দিয়ে গেছে, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জানা গেছে, পিতা আব্দুর মজিদ ছিলেন পুলিশের কনস্টেবল পদে কর্মরত। ছেলে মহিউদ্দিন মাহিকে কনস্টেবল পদে চাকরী পাইয়ে দেন। কনস্টেবল থেকে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন এসআই। পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পদক। মহিউদ্দিনের প্রতিটি অর্জনই ভালোভাবে গ্রহন করছিল রূপাতলী হাউজিং এলাকার বাসিন্দারা। কিন্তু পদোন্নতি ও পদক পাওয়ার পর হঠাৎই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সেই মহিউদ্দিন মাহি। জমি দখল আর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে নিজের বাসস্থান রূপাতলী এলাকায়ই পরিনত হন আতঙ্কে। আসতে যেতে দেখা হলে সালাম না দিলে আটক করে হয়রানি, মসজিদ কমিটিতে স্থান না পাওয়ায় রাস্তায় প্রকাশ্যে গালিগালাজ, বিরোধপূর্ণ জমি দখলে নিয়ে দিতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তি, মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে আটক করে নির্যাতন করে অর্থ আদায়, থানায় জিডি করতে গেলে টাকা আদায় প্রভৃতি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। মহিউদ্দিন মাহির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে জমা পড়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে।
জানা গেছে, রূপাতলী গ্যাসটারবাইন এলাকার বাসিন্দা রিপন মৃধা, রিপন আকন ও আফজাল হোসেন মিলে বিভিন্ন এলাকায় জমির ব্যবসা শুরু করেন। এই খবর শুনতে পেরে তাদের ডেকে নেন কোতয়ালী থানার তৎকালীন এসআই মহিউদ্দিন মাহি। তিনি জমি ব্যবসায়ী তিন বন্ধুর কাছে ৩ লাখ টাকা ছাঁদা দাবী করেন। টাকা না দিলে ক্রসফায়ার দিয়ে ফেলে দিবেন বলে হুমকি দেন। টাকা দিতে অস্বীকার করলে নেমে আসে মহিউদ্দিনের নির্যাতন।
রিপন মৃধা বলেন, ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর জমি ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন ও ২৭ অক্টোবর রিপন আকনকে মিথ্যা অভিযোগে মামলা দিয়ে তাদের থানায় ধরে নিয়ে সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে মারধর করে। এমন কি তাদের নাকে-মুখে গরম পানি ঢালে এবং তার শেখানো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদালতে দিতে বাধ্য করে। এ ছাড়া মিথ্যা অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাদের আসামি দেখিয়ে ২৯ অক্টোবর জবানবন্দি দেয়ার জন্য আদালতে প্রেরণ করেন। রিপন মৃধা বলেন, মানুষ ফাঁসাতে মহিউদ্দিন মাদক দিয়ে ধরিয়ে দিত। তেমনি আফজাল ও রিপন আকনকে মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে থানায় ঝুলিয়ে মারধর করেন। তাদের অপরাধ ছিল দাবীকৃত চাঁদা দেয়নি। এ ঘটনায় মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দিয়েছেন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যারা।
একইভাবে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়েছিল রূপাতলী ২৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহাবুব মোল্লাকে। মাহাবুব মোল্লার পরিবার স্বজনরা জানিয়েছেন, ২০১৬ সালের শেষের দিকে উকিল বাড়ি সড়কের একটি জমি নিয়ে দ্বন্দ্বে মাহাবুব মোল্লাকে প্রকাশ্যে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়েছিল মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিনের হয়রানি থেকে রেহাই পায়নি ২৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফ মোঃ আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, জমি ক্রয়-বিক্রয় যেখানে হতো, সেখানেই নাক গলাতো মহিউদ্দিন। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমার ওয়ার্ডের একটি জমি বিরোধ শালিস করতে গিয়ে টাকা দাবী করেন মহিউদ্দিন। সেখানে অস্ত্রের ভয় দেখান। এমনকি ক্রসফায়ার দিয়ে দিবেন বলেন হুমকি দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর অনিছুর রহমান।
রূপাতলী চান্দু মার্কেট শের-ই-বাংলা সড়কের বাসিন্দা হারিছুল ইসলাম জানিয়েছেন, শের-ই-বাংলা সড়কে আমার পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত জমিতে নজর পরে মহিউদ্দিনের। তিনি ২০১৯ সালের ২২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমাক বাসা থেকে ডেকে নিয়ে আসে। অস্ত্র দেখিয়ে বলে, তুই ওই জমির কাছে যাবি না। গেলে এনকাউন্টার দিয়ে দেব। জমির পাওয়ার অব এটর্নি আমি নিয়েছি। মহিউদ্দিনের আক্রমনাত্মক আচরণে আমি ভয় পেয়ে যাই। হারিছুল বলেন, নিরুপায় হয়ে আমি চিৎকার দিলে চারপাশের লোকজন বাইরে বেড়িয়ে আসে। লোকজন দেখে আমাকে গালিগালাজ করতে করতে তার বাসায় চলে যায়। আমি তার কথামত পিতার সম্পত্তি ছেড়ে না দেওয়ায় ওই হুমকির পরেও আমি কথা শোনায় একদিন তার বাসায় আমাকে ডেকে নেয়। সেখানে থানা পুলিশ ডেকে নিয়ে আমাকে অন্যের পুরাতন একটি ইয়াবা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে চালান দিয়ে দেন।
হারিছুল বলেন, এ নিয়ে পুলিশ কমিশনার বরাবর গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারী লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এখনো আমি আতঙ্কে আছি, কখন মহিউদ্দিন আমাকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে ক্রসফায়ার দেয়। হারিছুল বলেন, রেজাউল করিম মাদকসেবীও না। তাকে যেকোন ‘ইগো’ সমস্যার কারনে আটক করে নির্যাতন করেছেন। কারন মহিউদ্দিনকে কিশোররা সালাম না দিলে তাদের আটক করে হয়রানি করেন। হয়তো এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটেছে। তবে আমি নিশ্চিত রেজাউল মাদক ব্যবসায়ী বা মাদকসেবী নন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শের-ই-বাংল