অনলাইন ডেস্কঃ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বাঙ্গালী জাতির জনক স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রস্টা এবং প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে খুনীরা।
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙ্গালীর প্রতি পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির সকল অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬ শত ৮২ দিন (১২ বছর ৮ মাস) জেল খেটেছেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষনা দিয়েছেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে ওয়ারলেসের মাধ্যমে তিনি প্রথম, সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন।
যে নেতার ঘোষনা পেয়ে বীর বাঙ্গালী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনলো, সেই বঙ্গবন্ধুকে কি কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কখনো হত্যা করতে পারে ?
যুক্তি এবং বিবেক কি বলে ? হত্যাকারীদের পরবর্তী কার্যকলাপে কি প্রমান হয়না যে, তারা আদৌ বাংলাদেশ স্বাধীন করতে কখনও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি, বরং উপায় না দেখে এবং অনেকে পাকিস্তানের চর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো ? বিশ্বের শত শত যুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহারন বহু আছে। একে যুদ্ধকালীন একটি কৌশল হিসেবেই ধরা হয়। এই কৌশলটি ইংরেজীতে বলে A wolf in sheep’s clothing.
বঙ্গবন্ধু হত্যায় মূলত পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র এবং হত্যা কার্যকর এই তিনটি অংশে ভাগ করা ছিলো। পরিকল্পনায় ছিলো সরাসরি পাকিস্তান ও তাদের সংস্থা আইএসআই এবং বাংলাদেশে থাকা তাদের আস্থাভাজন এজেন্ট। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো বঙ্গবন্ধু সরকারের ক্ষমতালোভী কয়েকজন নেতা, কিছু সেনা কর্মকর্তা এবং এদের নির্দেশে সরাসরি হত্যায় অংশ নেয় কিছু সেনা সদস্য।
পরিকল্পনাকারী হিসেবে পাকিস্তান থাকবে এটা খুবই স্বাভাবিক। পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন ব্যাপক পরাজয়ের ক্ষতটা তখনও বেশ গভীর ছিলো। যুদ্ধকালীন তাদের সেনাদের ব্যাপক প্রানহানী এবং বিপুল অর্থের ক্ষতিসাধন পাকিস্তানের জনগণ ও সুশীল সমাজ একদম মেনে নিতে পারেনি। সরকারের তীব্র সমালোচনায় মূখর ছিলো সে সময়ের পাকিস্তানী পত্রিকাগুলো।
সেই সাথে ভারতের সাথে বঙ্গবন্ধুর গভীর বন্ধুত্বে পাকিস্তান এবং চীন ছিলো আরও উদ্বিগ্ন। তারা পরিস্কার বুঝে নিয়েছিলো শেখ মুজিব নামক এই হিমালয় যতদিন জিবীত থাকবে এবং তার পরিবারের সদস্যরা যতদিন জিবীত থাকবে, ততদিন বাংলাদেশকে চীন ও পাকিস্তানের তাবেদার রাস্ট্রে পরিনত করা সম্ভব হবেনা। (পাকিস্তানের সংবিধানে স্বাধীন বাংলাদেশকে তাদের কনফেডারেশন রাস্ট্র হিসেবে উল্লেখ করে রেখেছিল)
এজন্যই পাকিস্তান তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের গনতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে। এজন্য পাকিস্তান বেছে নেয় এক এক করে তাদের পুরনো বন্ধুদের।
বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ এবং মেজর ডালিম। তারা প্রথমেই তাদের দলে টানেন পাকিস্তান প্রেমী সিনিয়র অফিসার সে সময়ে সেনা উপ প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গ্রানাডা টেলিভিশনকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তি এক সময়ে দেওয়া সাক্ষাতকারে জেনারেল জিয়ার যুক্ত হবার বিষয়টি স্পস্ট স্বীকার করে বর্ননা করেন খুনী ফারুক ও রশিদ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেরদিন খন্দকার মোশতাক রাস্ট্রপতি হবার পর সেই রাতে বঙ্গভবনে খুনীরা সারারাত উল্লাস করে এবং পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান পর্যন্ত দেয়। এই তথ্য সে সময়ে বঙ্গভবনে চাকুরি করা বেশ কয়েকজনের লেখায় উল্লেখ আছে। এখানেই আমার প্রথম প্রশ্ন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দিলো যারা, তাদের কি কোনভাবে আমরা মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্য বলতে পারি? পরবর্তিতে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় বসবার পর রাজাকারদের ক্ষমতায় বসিয়ে, শাহ আজিজের মতো কুখ্যাত পাকিস্তানের দালালকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে তিনি কি নিজেকে পাকিস্তানের পক্ষের একজন সেনা নায়ক হিসেবে প্রমান করেন নি?
১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসবার আগ মুহূর্তে পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন আরেক খুনী মেজর ডালিম। সেখানেই তার স্ত্রীর কবর এবং নিঃসন্তান ডালিম পাকিস্তানের একটি মেয়েকে দত্তক নিয়ে পালন করেন। এখানে আমার জিজ্ঞাসা, বিশ্বের কোন দেশ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বীর উত্তম খেতাব পাওয়া সেনা সদস্যকে তার দেশে আশ্রয় দেবে? থাকা খাওয়া সহ সরকারিভাবে সার্বক্ষনিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে? এতে করে কি প্রমান হয়না যে মেজর ডালিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হয়েই পাকিস্তান থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন? অবস্থা অনুকুলে ছিলোনা বলে তারা যুদ্ধের ফলাফলটা পাকিস্তানের পক্ষে নিতে পারেননি?
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সকল সেনা সদস্যদের বীরত্বপূর্ন যুদ্ধকালীন নানা অপারেশনের ঘটনা আমরা ইতিহাস আকারে পেয়েছি, শুধু পাইনি জেনারেল জিয়া ও বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত বাকি খুনীদের। কারন স্পস্ট, এরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো স্যাবোট্যাজ করতে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে কাজ করতে। কোন যুদ্ধের শুরুতেই যেমন আগাম ফলাফল নিশ্চিত হওয়া যায়না, এই সকল পাকিস্তানী এজেন্টরাও তেমনি ধারনা করতে পারেনি যে দেশ স্বাধীন করতে আমাদের দেশের বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সামরিক বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কতটা ভয়ংকর যোদ্ধা হয়ে উঠতে পারে। আর তাই সেক্টর কমান্ডার হয়েও যেমন জিয়া পাকিস্তানীদের পক্ষে কোন সুবিধা আদায় করতে পারেনি, তেমনি পারেনি ডালিম ও বঙ্গবন্ধুর বাকি খুনীরা।
একটু সময় নিয়ে ইতিহাস ও যুদ্ধের বিভিন্য ঘটনা পর্যালাচনা করলে এই সত্যটাই সামনে আসবে এবং প্রমানীত হবে যে জিয়া, ডালিম সহ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কেউ ই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন, তারা শতভাগ পাকিস্তানের এজেন্ট।
এই সকল খুনীদের সাথে আরেক ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে থাকা লোকটির নাম খন্দকার মোশতাক। মুজিবনগরের অস্থায়ী সরকারের তিনি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার পাকিস্তানের প্রতি প্রেম এবং গোপন আতাত টের পেয়ে অস্থায়ী
সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ তাকে আমেরিকায় পাঠাবার পরিবর্তে লন্ডনে বসবাস করা আবু সাইদ চৌধুরীকে সেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং, যতভাবেই দেখিনা কেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পাকিস্তান প্রেম এবং পাকিস্তানের প্রতি আজ্ঞাবহ হবার প্রমানই মেলে। এত সব তথ্য প্রমান থাকবার পর আজও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মুক্তিযুদ্ধকালীন দেওয়া খেতাব বাতিল না হওয়াটা শুধু দুঃক্ষজনকই নয়, বরং খেতাবপ্রাপ্ত প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবমাননাও বটে।
আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে ওঠা একজন শতভাগ দেশপ্রেমিক সাধারন নাগরিক হিসেবে দাবী করছি, এই দেশের জাতীর জনকের হত্যাকারীরা সকলেই শতভাগ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেওয়া ভেড়ার পোশাকের কতগুলো নেকড়ে মাত্র। এদের সকলের মুক্তিযোদ্ধা খেতাব সহ মিথ্যা বীরত্বের সকল খেতাব বাতিলের দাবী জানাচ্ছি। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের প্রতিটি মানুষকে নিয়ে রাজপথে নেমে এই দাবী আদায়ের পক্ষে সংগ্রাম শুরু করবো।
বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে আমরা সর্বদা আপোষহীন।
এইচ রহমান মিলু
লেখক ও সমাজকর্মী